Sunday, June 14, 2020

খাবো কি ? লিপিবদ্ধ করেছেন হাফেজ মোঃ রেজাউল করিম রাজু


খাবার, বস্ত্র, বাসস্থান এই তিনটি হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। দুনিয়াতে থাকতে হলে এগুলো প্রয়োজন। তাই মানুষ তার নিজের ও তার অধিনস্থদের মৌলিক চাহিদা মিটানোর জন্য ব্যাতিব্যাস্ত। রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে, পাহাড়-পর্বতে, নদি-নালা, খাল-বিলে অফিস ও আদালতে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। সকলে ব্যাস্ত, দিন যায় রাত আসে ব্যাস্ততার চাকা ঘুরতেই থাকে। চলতেই থাকে মানুষের আশা। বাড়তেই থাকে মানুষের চাহিদা। মহাবিশ্বের বুকে পৃথিবী যেমন তার চিরচারিত নিয়ম অনুযায়ী ঘুরপাক খাচ্ছে- ঠিক তেমনি পৃথিবী নামক ভূখন্ডের উপরে হাড় ভাংগা পরিশ্রম করে দিক হারা পথিকের মত ঘুরপাক খাচ্ছে এই মানুষ। পৃথিবীর উপরে মহান প্রভুর হুকুম যা, সেই তাই পালন করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ বছরের পর বছর ধরে । কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব এই মানুষ কি কখনো ভেবে দেখেছে, তার উপরে তার রবের হকুম কি? তার রব কিজন্য তাকে সৃষ্টি করেছে। কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন- আমি মানব এবং  জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি এক মাত্র আমার ইবাদতের জন্য।
প্রিয় পাঠক-
দ্বীন ছেড়ে দুনিয়া নিয়ে ব্যাস্ত পথ ভোলা পথিকদের যখন বলা হয়, তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর ডাকে একটু সাড়া দাও, তার ইবাদত করো। তার হুকুম-আহকাম গুলো মানার চেষ্টা করো। এভাবে দুনিয়ার পিছনে সব সময় পড়ে থেকো না।  তখন তারা আগ-পেচ না ভেবেই তড়িৎ গতিতে উত্তর দেই-- আমরা খাবো কি?
যুগের পর যুগ ধরে মানুষ দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে দূনিয়া নিয়ে ব্যাস্ত থাকার পিছনে এই একটি মাত্র কথা তারা তোতা পাখির মত বার-বার আওড়িয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে আমরা খাবো কি?
প্রিয় পাঠক-
আজকের আলোচনার ভিতরে আমাদের শায়েখ এই কথাটির অসারতা তুলে ধরলেন। শায়েখ দুনিয়াদারদের দ্বীন পালনে দুরে থাকার সব থেকে বড় হাতিয়ার যেই কথাটি সেটা তাদের ঘাড়ের উপরেই চাপিয়ে দিলেন। শায়েখ বললেন- মানুষ বলে খাবো কি? অবশ্যই এটা একটি যৌক্তিক কথা। বুদ্ধিসম্পূর্ণ কথার এটা প্রথম স্তর।
শায়েখ বলেন- এটা প্রথম বলেছে- ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) । তিনি যখন প্রথম খলিফা হলেন, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ করে জীবিকার জন্য বের হলেন। পথের ভিতরে এক সাহাবি প্রশ্ন করলেন আপনি কোথায় যাচ্ছেন? খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বললেন- তাহলে আমি কোথা থেকে আমার পরিবারকে খাওয়াবো।  এক কথায় আমি খাবো কি।
প্রিয় পাঠক- এখানে একটা কথা না বল্লেই নয়- সেটা হলো- অনেকে এই ধরনের কথা বার্তাকে শিরক বলে। সত্য কথা হলো এই ধরনের কথা বার্তাকে যারা শিরক বলে- তারা না শরিয়তের মেজাজ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে আর না শরিয়ত পালন কারি মানুষের বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। এই ধরনের লোকদের ফতুয়া দেওয়া তো দুরের কথা, তাদের মুখে “ফ” শব্দ উচ্চারন করাও ঠিক না। এখন আমরা আমাদের মুল কথায় ফিরে আসি।
মুহতারাম উস্তাদ বললেন- এই কথাটি (আমি কি খাবো?) দুই দিক দিয়ে একটা মানুষের ব্যালেন্স করে।
1/ যা প্রয়োজন তাই করবে
2/ যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করবে।

ব্যালেন্সটা ঠিক এভাবে হবে যে- এটার কারনে সে দুনিয়াতে কিছুটা আয় উপার্জন করবে, যেহেতু খেতে হলে উপার্জন করা লাগবে- আবার যতটুকু হলে প্রয়োজন মিটে যাই ততটুকু করার পর মহান আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করবে। এভাবে এই কথাটি একজন ব্যাক্তির দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে সমন্বয় করবে। তাই শায়েখ বলেন- কি খাবো - এই কথাটি আমাদেরকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে শক্ত ভাবে ধরে রাখতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো এই কথাটি যারা বলছে তাদেরকে নিন্দা করা হচ্ছে কোন যুক্তিতে- এর সহজ উত্তর হলো- এমন প্রত্যেক ব্যাক্তিকে নিন্দা করা হবে যারা মুখে এক বলে আর কাজে আর এক করে। সমাজের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত এমন সব মানুষ এটা বলতে বাধ্য যে- এমন দ্বিমুখি আচরন ঠিক না। আর মহান আল্লাহ বলেন – “তোমরা এমন কেনো বলো যা তোমরা করনা”।
এখানে দ্বিমুখি আচরনটা হলো--মানুষ বলছে আমরা খাবো কি? কিন্তু প্রকৃত কথা হলো, খাওয়া পরা ও থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করেই মানুষ ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না। খাওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা উপার্জন, পরার জন্য নিজ শহর ছেড়ে ভিন শহরে বা নিজ দেশ ছেড়ে ভিন দেশে যাওয়া। নতুন নতুন পোশাক ক্রয় করা, আর থাকার জন্য দেশ-বিদেশে এবং তালার উপরে তালা বাড়ি করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে গভির রাত পর্যন্ত লাগামহীন ভাবে বছরের পর বছর ধরে যে পরিশ্রম তারা করছে এটার কি কোনো প্রয়োজন আছে? এটা কি খাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে পুরো দুনিয়া পাওয়ার ধান্দা না? শুধু মাত্র খাওয়ার জন্য কি এত কিছু করা লাগে ?
এই কারনে শায়েখ বলছেন- আমি খাবো কি? এই কথাটি আমাদের শক্ত করে ধরে রাখতে হবে- কারন তারা মুখে বলছে আর তার বিপরীত কাজ করছে। আর আমরা মুখে যেটা বলবো সেটা কাজে পরিণত করে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।  তখনি আমরা দুনিয়া থেকে দুনিয়াও পাবো, আবার আখিরাত পাওয়ার জন্য ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার  প্রচুর সময় পাবো। যেটা আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার উভয় ক্ষেত্রে কল্যাণ বয়ে আনবে।
শায়েখ বলেন- আমাদের নীতি কেমন হবে এটা কুরআন থেকে শিখতে হবে
মহান আল্লাহ বলেন-
فَإِذَا فَرَغْتَ فَٱنصَبْ 

অতএব যখন অবকাশ পাবে, তখন (আল্লাহর পথে) পরিশ্রম করবে।


وعن مجاهد : فإذا فرغت من دنياك ، فانصب في صلاتك

প্রিয় পাঠক- পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটির দিকে একটু লক্ষ করুন- মহান আল্লাহ রসুলকে আদেশ করছেন-  আপনি যখন সুযোগ পান তখন আপনার রবের ইবাদতে মশগুল থাকেন।
শায়েখ বলেন- কুরআন আমাদের শেখাচ্ছে- দুনিয়াবী কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর কাজে মনোনিবেশ করতে। আর আমরা মানুষদের শেখাচ্ছি কোনো রকম আল্লাহর ইবাদত নামকে-ওয়াস্তে শেষ করে সারাক্ষন দুনিয়াবি কাজ-কর্মে ব্যাস্ত থাকতে। সাহাবাদের অভ্যাস ছিলো- নামাজের সময় যদি কোনো কাজ থাকতো তাহলে সেটা শেষ করে তার পর নামাজে দাড়াতো। মোট কথা তারা সব কাজে তাড়াহুড়া করলেও নামাজ টা ধীরে-ধীরে আদায় করতো। আর আমাদের আমল তাদের বিপরীত। আমরা সব কাজ ধীরে-ধীরে আদায় করলেও নামাজটা করি খুব তাড়াতাড়ি। এটা আমাদের একটা বদ অভ্যাস। যেটা সাহাবাদের বিপরীত তরিকা। আসুন এটা আমরা বর্জন করার চেষ্টা করি।

আলোচনা চলতে চলতে হটাৎ করে শায়েখ তার সামনে উপবিস্ট এক ছাত্র- হাফেজ হাদি কে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন--  হাদি - বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে- যেনো আল্লাহ প্রয়োজন মাফিক রিজিকটা দুনিয়া থেকে দেন। শায়েখ বলেন- আয় উপার্জন করা যেহেতু দুনিয়াবী বিষয় অতএব এটা যেনো দুনিয়া থেকেই আসে। দ্বীনের ভিতরে থেকে (ইমামতি করে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, তারাবি পড়িয়ে অথবা ওয়াজ করে)  দুনিয়া উপার্জন করা যদিও জায়েজ- তবুও এটা সুস্থ কোনো তরিকা নয়। সুস্থ ও নিরাপদ তরিকা হলো দুনিয়াবী বিষয় দুনিয়া থেকেই উপার্জন করা। দ্বীন আর দুনিয়া মিশিয়ে না ফেলা। এই পদ্ধতিতে দ্বীনটা যেমন সুরক্ষিত থাকে। সামাজের বুকে প্রকৃত সম্মান টাও থাকে। আল্লাহর বিধান গুলো মানুষের সামনে উচু গলায় প্রচার করাও যাই।
শায়েখ বলেন- এই যে রাজু ভাই- খুব সর্তকতার সাথে ইমান ও আমল সেফ রেখে ইমামতি করে তাও আমার কছে পছন্দ না তার রিজিকটা সেখান থেকে আসুক। যদিও জায়েজ।
প্রিয় পাঠক- এই রাজু ভাই কে চেনেন- সে হচ্ছে শায়েখের এক অধম ছাত্র- সব ছাত্র থেকে একটু ভিন্ন- সবাই শায়েখের আদর্শ যেভাবে মানে সে এখনো পরিপূর্ণ ভাবে মানতে পারেনা। তবে সে মনে প্রানে চেষ্টা করে সেটা মানার জন্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সে পরিবার ও ওরফের কারনে পরিপূর্ন মেনে উঠতে পারে না। তো আপনারা সকলে তার জন্য মন খুলে নিশিত রাতে একটু দোয়া করবেন। যেনো আল্লাহ পাক তার ব্যাবসার ভিতরে রককত দেন। এমন বরকত ও মন-মানসিকতা দেন যেনো দ্বীন দিয়ে দুনিয়া করার প্রয়োজন না হয়। দুনিয়া যেনো দুনিয়ার থেকেই হয়। হে আল্লাহ তুমি কবুল করো। যার ভিতরে কল্যান তুমি সেটাই করো।

প্রিয় পাঠক- এর পর শায়েখ বলেন- প্রত্যেটা মানুষের জীবনে তিনটা সন্ধি আছে- 
1/ বয়ো সন্ধি (উঠতি বয়সে ইলম ও আমলের মধ্যে পরিপূর্ণ ভাবে থাকার চেষ্টা করা। এটা নষ্টা হলে সব শেষ।)
2/ আয়ো সন্ধি (উপযুক্ত বয়সে যাওয়ার সাথে সাথে একটা কর্ম করা। নিজের মেজাজের সাথে সেট ও সেফ হয় এমন একটা কর্মের ভিতরে ঢুকে পড়া। এটা করতে যারা ব্যার্থ হবে তারা সারাটা জীবন সামাজ ও পরিবারের মানুষের কাছে লাঞ্চিত হবে।
3/ বিয়ে সন্ধি (দ্বীনদার, ছোট ও নিজের আর্থিক অবস্থার থেকে কিছুটা নিম্ন মানের মেয়ে বিয়ে করার চেষ্টা করা। যদিও ভালো মন্দ আল্লাহর হাতে- তবুও আমাদের চেষ্টা করা।)
শায়েখ বলেন- বউ যদি খারাপ হয় তাহলে দ্বীন মানা তো দুরে থাক দুনিয়াও ভোগ করা যাবে না। 
শায়েখ বলেন, একজন ব্যক্তি ইমামতি করতো তার একটা বউ ছিলো খুব ভালো - সে বউটা মারা যাবার পর সে আর একটা বিয়ে করে। কিন্তু সেই বউ টা খুব লোভি প্রকৃতির হয়। আগে সে ইমামতি করার সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি খেতো না - কিন্তু এখন সে,  তার বউ এর চাপে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে বাটিতে করে তরকারি চেয়ে চেয়ে খাই)।

শায়েখ বলেন-
এই তিনটা সন্ধি সেই -বিচক্ষনতার সাথে পার করতে পারবে- যে এই বিষয়ে দক্ষ তার পরামর্শ মেনে কাজ করবে- আশা করা যাই, সে দুনিয়াতে সুখে থাকতে পারবে। আর দুনিয়াতে যে সুখে থাকতে পারবে সে মন প্রান খুলে আল্লাহর ইবাদত করতে পারবে। আর আখিরাতের সুখ মহান প্রভুর হাতে।

আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন।

(নোটঃ আমার সম্মানিত শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীরের নসিহত থেকে নোট করেছেন হাফেজ রেজাউল করিম রাজু।  হে আল্লাহ, তুমি উভয়কেই জান্নাতের সুউচ্চ সম্মান দান করো ও জান্নাতী রমনীদের কুফু করে দাও এবং তোমার নিকটবর্তী বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করে নাও। সেই সাথে আমাদেরকেও।)


2 comments:

  1. আমিন, আপনার এই কাজটাও অনেক সুন্দর হয়েছে ভাইজা।

    ReplyDelete

দ্বীনের দাওয়াত হলো নিজে দ্বীনের উপর টিকে থাকা।